আমেরিকানদের বিচিএ কান্ডকারখানার গল্প বলার সময় কিসিং বুথের গল্পটা আমি খুব আগ্রহ করে বলি।শ্রোতারা চোখ বড় বড় করে শোনে।যুবক বয়েসীরা গল্প শেষ হবার পর মনে মনে দীঘ্ নিঃশ্বাস ফেলে হয়তোবা ভাবে,আহা তারা কি সুখেই না আছে।
গল্পটা বলা যাক।
আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে "হোমকিসিং" বলে একটা উৎসব হয়।এই উৎসবে আনন্দ মিছিল হয়,হৈচৈ গান বাজনা হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচে সুন্দরী ছাএীকে হোমকিসিং কুইন নিব্াচিত করা হয়।এই হোম কামিং রানিকে ঘিরে সারাদিন চলে আনন্দ-উল্লাস।
আমার আমেরিকাবাসের প্রথম বষে্ হোম কামিং কুইন হলো আন্ডার-গ্রাজুয়েট ক্লাসের এক ছাএী।স্পেনীশ আমেরিকান,রুপ ফেটে পড়ছে।কিছুক্ষন এই মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলে যুবকের মধ্য এক ধরনের হাহাকার জমে উঠতে থাকে,জগৎ সংসার তুচ্ছ বোধ হয়।সম্ভবত এই শ্রেনীর রুপবতীদের প্রসঙ্গে বলা হয়েছে,মুনীগন ধ্যান ভাঙি দেয় তপস্যার ফল।
মেয়েটিকে নিয়ে ভোর এগারোটার দিকে একটা মিছিল বের হল।আমার ইচ্ছা করলো মিছিলের ভিড়ে যাই।শেষ পয্ন্ত লজ্জা লাগলো।ল্যাবরেটরীতে চলে এলাম।অনেকগুলো স্যাম্পল জমা হয়েছে।এদের এক্সরে ডিফ্রেকশান প্যাটান জানাতে হবে।ডিফ্রেকশান মিশিনটা ভালো কাজ করছে না।ছবি পরিষ্কার আসছে না।দুপুর একটা পয্ন্ত কাজ করলাম।ঠিক করে রাখলাম লাঞ্চ সারার জন্য আধা ঘন্টা বিরতি দিব।
মেমোরিয়াল ইউনিয়নে লাঞ্চ খেতে গিয়েছি।লক্ষ করলাম মেমোরিয়াল ইউনিয়নের দোতলায় অস্বাভিক ভিড়।কৌতহলী হয়ে দেখতে গেলাম।
জটলা আমাদের হোমকিসিং কুইনকে ঘিরেই।এই রুপবতী বড় বড় পোষ্টার সাজাচ্ছে।পোষ্টারগুলোতে লেখাঃ নীল তিমিরা আজ বিপন্ন।নীলতিমিদের বাঁচান।জানা গেল এই হোমকামিং কুইন-নীলতিমিদের বাঁচাও সংঘের একজন কমী্।সে আজ নীলতিমিদের জন্য অথ্ সংগ্রহ করবে।
নীলতিমিদের ব্যাপারে আমি তেমন কোন আগ্রহ বোধ করলাম না।মানুষই যেখানে বিপন্ন সেখানে নীলতিমিদের নিয়ে লাফালাফি করার কোন অথ্ নেই।তবু দাড়িয়ে আছি। রুপবতী মেয়েটির আনন্দোজ্জ্বল মূতি্ দেখতে ভালো লাগছে।
আমি লক্ষ করলাম,কাঠগড়ার মত একটা বেস্টনী করা হচ্ছে।সেখানে লাল কালিতে ঠোঁঠের ছবি এঁকে নিচে লেখা হল "কিসিংবুথ"-চুম্বন কক্ষ।তার নিচে লেখা চুমু খাবার নিয়মকানুন।
(১)জড়িয়ে ধরবেন না,মুখ বাড়িয়ে চুমু খান।
(২)চুমু খাবার সময় খুবই সংক্ষিপ্ত।
(৩)প্রতিটি চুমু এক ডলার।
(৪)চেক গ্রহন করা হবে না।
(৫)বড় নোট গ্রহনযোগ্য নয়।
ব্যাপারটা কি বুঝতে পারছি না।আমার পাশে দাড়ানো আমেরিকান ছাএ বুঝিয়ে দিল।
হোমকামিং কুইন "কিসিংবুথে দাড়িয়ে থাকবে।অন্যরা তাকে চুমু খাবে এবং প্রতিটি চুমু এক ডলার করে দিবে।সেই ডলার চলে যাবে নীলতিমিদের বাঁচাও সংঘের ফান্ডে।
আমি হতভম্ব।
প্রথম মনে হলো পুরো ব্যাপারটা এক ধরনের রসিকতা। আমেরিকানরা রসিকতা পছন্দ করে।এটাও বোধ হয় মজার রসিকতা।
দেখা গেল ব্যাপারটা মোটেই রসিকতা নয়।মেয়েটি কিসিংবুথে দাড়িয়ে গেল।সঙ্গে সঙ্গে তার সামনে লাইন।এক একজন এগিয়ে আসছে,ডলার দিচ্ছে,মেয়েটিকে চুমু খেয়ে সরিয়ে যাচ্ছে,এগয়ে আসছে দিতীয় জন।আমি মুগ্ধ বিষ্ময়ে দেখছি।
মেয়েটির মুখ হাসি হাসি।তার নীল চোখ ঝকমক করছে।যেন পুরো ব্যাপারটা খুবই আনন্দ পাচ্ছে।আনন্দ ছেলেরাও পাচ্ছে।একজনকে দেখলাম দশ ডলারের একটা নোট দিয়ে পরপর দশবার চুমু খেল।এতেও তার স্বাদ মিটল না।মানিব্যাগ খুলে বিশ ডলারের একটা নোট বের করে উঁচু করে সবাইকে দেখালো।সঙ্গে সঙ্গে হাততালি,যার মানে চালিয়ে যাও।ইউনিভাসিটির মেথর,ঝাড়ুদার এরাও ডলার নিয়ে এগিয়ে এল।এরা বেশ গম্ভীর।যেন কোন পবিএ দায়িত্ব পালন করছে।চুমু খেল খুবই শালীন ভঙ্গিতে-মন্দিরের দেবমূতি্কে চুমু খাবার ব্যাপস্থা থাকলে হয়তো এভাবে খাওয়া হত।কিছুক্ষনের মধ্য ভারতীয় ছাএরা চলে এলো।এরা চুমু খাবার লাইনে দাড়ালো না।এক জায়গায় দাড়িয়ে জটলা পাকাতে লাগলো।এ ওকে ঠেলাঠেলি করছে।কেউ যেতে চাচ্ছে না।শেষ পযন্ত একজন এগিয়ে এল,এর নাম উমেশ।বোম্বের ছেলে।মানুষ যে বানর থেকে এসেছে এটা উমেশ কে দেখলেই বোঝা যায়।তার জন্য ডারউইনের বই পড়তে হয় না।উমেশ চুমু খাবার পর পরই অন্য ভারতীয়দের লজ্জা ভেঙ্গে গেল।তারাও লাইনে দাড়ালো।আমি ল্যাবরেটরীতে চলে এলাম।আমার প্রফেসর তার কিছুক্ষণের মধ্যই এক্সরের কাজ কী হচ্ছে তার খোজ নিতে এলেন।ডিফ্রেকশান প্যাটান দেখতে দেখতে বললেন,তুমি কি ঐমেয়েটিকে চুমু খেয়েছ?
আমি বললাম, না।
না কেন?মাএ এক ডলারে এমন রুপবতী একটি মেয়েকে চুমু খাবার সুযোগ নষ্ট করা কি উচিত?
আমি বললাম এভাবে চুমু খাওয়াটা আমদের দেশের নীতিমালায় বাধা আছে।
বাধা কেন?চুমু হচ্ছে ভালোবাসার প্রকাশ।তুমি যদি তোমার শিশু কন্যাকে প্রকাশ্যে চুমু খেতে পার তাহলে একটি তরুনী কে চুমু খেতে পারবা না কেন?মূল ব্যাপারটা হচ্ছে ভালোবাসা।
আমি বললাম,এই মেয়েটির ব্যাপারে তো ভালোবাসার প্রশ্ন আসছে না।
তিনি অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে বললেন,আসবে না কেন?এই মেয়েটিকে তুমি হয়তো ভালোবাসছো না,কিন্তু তার রুপ কে তুমি ভালোবাসছো।বিউটি ইজ ট্রুথ।তাই নয় কি?
আমি চুপ ক
রে রইলাম।তিনি বললেন,একটি নিজন দ্বীপে যদি তোমাকে ঐ মেয়েটির সঙ্গে ছেড়ে দেয়া হতো তাহলে তুমি কি করতে?চুপ করে বসে থাকতে?
আমি নিচু গলায় বললাম,মুনীগন ধ্যান ভাঙি দেয় তপস্যার ফল।
অধ্যাপক বিরক্ত গলায় বললেন এর মানে কি?
আমি ইংরেজী তে তাকে ব্যাখ্যা করে দিলাম।অধ্যাপক পরম প্রীত হলেন।
আমি বললাম তুমি কি চুমু খেয়ে এসেছ?
না এখন ভীড় বেশী।ভীড়টা কমলেই যাব।
বিকেল চারটায় এক্সরে টেকনিশিয়ান ছুটে এসে বলল,বসে আছ কেন?এক্ষনি মেমোরিয়াল ইউনিয়নেচলে যাও।কুইক।কুইক।
চারটা থেকে চারটা এিশ,এই আধঘন্টার জন্যে চুমুর দাম কমানো হয়ছে।এই আধঘন্টার জন্যে ডলারে দুটো করে চুমু।
টেকনিশিয়ান যেমন ঝড়ের গতিতে এসেছিল তেমনি ঝড়ের গতিতে চলে গেল।আমি গেলাম দেখতে। লাইন এখনও আছে।লাইনের শুরুতেই উমেশ কে দেখা গেল।সে মনে হয় লাইন লাইনেই আজকের দিনটা কাটিয়ে দিচ্ছে।আমার প্রফেসরকেও দেখলাম।এক ডলারের একটা নোট হাতে দাড়িয়ে।তিনি আমাকে দেখে হাত ইশারা করে ডাকলেন।
গল্পটা আমি এই জায়গাতে শেষ করে দেই।শ্রোতারা ব্যাকুল হয়ে জানতে চায়,আপনি কি করলেন?দাঁড়ালেন লাইনে?
আমি তাদের বলি,আমি লাইনে দাঁড়ালাম কি দাঁড়ালাম না,তা মূল গল্পের জন্য অনাবশ্যক।
অনাবশ্যক হোক আর না হোক,আপনি লাইনে দাঁড়ালেন কি না বলুন।
আমি কিছুই বলি না।বিচিএ ভঙ্গিতে হাসি।সে হাসির দু'রকম অথ্ই হতে পারে।